এক এক করে ক্ষমতাধর সেই সব মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের কাজ রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালনার নির্দেশ দেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইবু্যনাল গঠিত হয়। তাতে ফাঁসির রায় হয়েছে কয়েকজনের এবং তা যথারীতি কার্যকর করা হয়েছে। বাকিদের বিচার চলছে। এই সময় বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নের রোল মডেলে রূপান্ত্মরিত করতে পেরেছেন তিনি, যা এখন আন্ত্মর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহমদ
শেখ মুজিব মানে মুক্তি, সে মুক্তি কোনো ভৌগোলিক মুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তা অর্থনৈতিক মুক্তিসহ মানুষের মৌলিক বিকাশের ধারা ও প্রবাহকে উন্মুক্ত করে থাকে। শেখ মুজিব একটি আদর্শের নাম। শেখ মুজিব মানে একটি প্রত্যয় ও দর্শন। শেখ মুজিব মানে প্রাতিষ্ঠানিকতা। জাতি রাষ্ট্র গঠনের দর্শন থেকে উন্নয়নশীল দেশের পদার্পণ ঐতিহাসিকভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। যে প্রেরণায় বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া থেকে উন্নয়নশীল জাতিতে পদার্পণ করেছে তার পেছনে কাজ করেছে বঙ্গবন্ধুর অবিচল অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব এবং তার সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা। আমরা সমাজ ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই জানতে পারি, নির্যাতিত এবং অবহেলিত মানুষের প্রতি যাদের অসীম মমতা রয়েছে, সকল প্রকার অন্যায়ের বিরম্নদ্ধে সোচ্চার, মহৎ কিছু করার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে যাদের, এমন মানুষই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। সেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী ব্যক্তিটি কেউ নয়, তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙালি হিসেবে তিনি বাঙালির যত রকম বঞ্চনা ছিল তা থেকে তাদের উদ্ধার করার ব্রত নিয়ে চারণ কবির মতো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্ত্মানের সর্বত্র ঘুরে বেরিয়ে মানুষের মধ্যে জাগরণ আনার চেষ্টা করেন। ফলে রাজরোষ তার ওপর নিপতিত হয়। অবশ্য তাতে তিনি দমে না গিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে বাঙালি জাতির মুক্তির পথ ও উপায় খুঁজে ফিরেছেন। বেছে নিয়েছেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথও। বছরের পর বছর তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে গোটা বাঙালি জাতিকে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। পশ্চিমা শোষণ আর দুঃশাসনের বিরম্নদ্ধে জাগিয়ে তুলেছেন বাঙালি জাতিকে। মুক্তির যথার্থ রূপ রেখা প্রণয়ন করেছেন তিনি তার মেধা ও মনন প্রয়োগে। আর মানুষকে প্রাণঢালা ভালোবাসা দিয়ে। যে ভালোবাসার কারণে বাঙালিরা তাকে নিজেদের আত্মার আত্মীয় ভেবেছে। আর তারই কথায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে সকল প্রকার ত্যাগ স্বাধিকারে।
বাঙালি জাতিকে শাসন ও শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম, যুদ্ধ ও নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেননা, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ১৯৪৭ সালে পাকিস্ত্মানের সৃষ্টি হলেও বাঙালির কোনো লাভ হয়নি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত্ম দীর্ঘ ২৩ বছরের বহুবিধ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হতে তার পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা অর্জন করি আমাদের হাজার বছরের প্রত্যাশিত স্বাধীনতা। 'বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাস, স্বাধীনতার স্থপতি, স্বাধীনতার ঘোষক' ইত্যাদি বিষয় ও ঘটনাবলি ঐতিহাসিক স্বীকৃত সত্য। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অনায়য়সে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধও রয়েছে, রয়েছে ইতিহাস,' তা কেবল আমাদের দেশবাসীরই জানা এমন নয়, বিশ্ববাসীও ঠিক মতো তা অবহিত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় উচ্চাভিলাষী ঈর্ষাপরায়ণ সেনা সদস্য নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে ও আত্মীয়-স্বজনসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে। তাকে হত্যার ভেতর দিয়ে জাতির স্বপ্নকে মুছে ফেলতে চায়। মুছে ফেলতে চায় একটি অভু্যত্থান, একটি আন্দোলন এবং বাঙালি জাতি নির্মাণের কারিগরের মহাকাব্যিক অমর গাঁথার গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসকে। কিন্তু ওই ঘাতক দুর্বৃত্তরা ভাবতে পারেনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নন। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করেছেন। ফলে তিনি ইতিহাসে অক্ষয় ধ্রম্নব তারার মতো চির ভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকবেন সন্দেহাতীতভাবে। ঘাতকদের হাতে ঐ দিনে পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। সে সময় শেখ হাসিনা তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে গবেষণারত বিজ্ঞানী স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে অবস্থান করছিলেন। আর এটা বোধ হয় সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য ছিল সৌভাগ্যের। ঐ সময় তিনি যদি বাংলাদেশে থাকতেন, তাকেও হারাতে হতো। কিন্তু তিনি দেশের বাইরে থাকায় আলস্নাহর অসীম কৃপায় সফল রাষ্ট্র পরিচালনার ভূমিকায় তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
শেখ হাসিনা আত্মীয়-স্বজন সব হারিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে ৩৫ বছর বয়সী একজন স্নেহময়ী জননী দুই সন্ত্মানকে বিদেশ ভূমিতে রেখে স্বদেশে পা রাখেন বৈরী রাজনৈতিক অবস্থার মাঝে। ঢাকায় ফিরে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে তিনি এক বক্তব্যে বলেন, 'বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।' তার যেই কথা সেই কাজ। তিনি দেশে এসে চুপচাপ শোকতাপ করে সময় কাটাননি। সে সময়ে তিনি নেতৃত্বশূন্য আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর শুধু প্রাণসঞ্চারের জন্য নয়, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এ স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার জন্যই তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। এ বিশ্বাস এখন সবার ভেতরই দৃঢ়তর হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি ছাড়াও অনেকটা ঝড়ঝাপ্টার মধ্য দিয়ে জননেত্রীর নেতৃত্বে দল শুধু ফিরে দাঁড়ায়নি। ১৯৮১ থেকে '৯৬ পর্যন্ত্ম ১৫ বছরের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশাল বড় বিজয় নিয়ে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় এসে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার করেন। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদকালে শেখ হাসিনার বড় অর্জন যুদ্ধাপরাধীনদের বিচার করা এবং আদালতের রায় কার্যকর করা। এই অসম্ভব কাজটি তিনি হাতে নেন।
এক এক করে ক্ষমতাধর সেই সব মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচারের কাজ রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালনার নির্দেশ দেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইবু্যনাল গঠিত হয়। তাতে ফাঁসির রায় হয়েছে কয়েকজনের এবং তা যথারীতি কার্যকর করা হয়েছে। বাকিদের বিচার চলছে। এই সময় বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নের রোল মডেলে রূপান্ত্মরিত করতে পেরেছেন তিনি, যা এখন আন্ত্মর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে কত যে নাটক। ওই সব নাটক তার কাছে পাত্তা পায়নি বরং তিনি নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করার ব্যবস্থা করেছেন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ এখন চতুর্থ চাল উৎপাদনকারী দেশ। শেখ হাসিনা নিজেই নিজের তুলনা। তবে তাকে তুলনা করতে হয়, সে ক্ষেত্রে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নারীদের মধ্যে ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীলংকার শ্রীমাভো বন্দরনায়েক তাদের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। তারা যেভাবে দেশ ও জাতিকে বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরেছিলেন, বাংলাদেশে তিনবারে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, আমাদের প্রিয় নেত্রীও সেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। তার অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। বিশ্বব্যাপী এখন তিনি উন্নয়নের রোল মডেল। রূপকল্প ২০২১ ধার্য করা হয়েছে; বাংলাদেশ ক্রমেই হয়ে উঠছে মধ্য আয়ের একটি শক্তিশালী দেশ। তবে তার কর্মকা- তার মানসিকতা, দেশের প্রতি অঙ্গীকার, জনতা ও দেশের জন্য গভীর ভালোবাসা এবং তার সেবা পরায়নতা, চিন্ত্মার দূরদর্শীতা আর কূটনৈতিক সাফল্য তাকে অনেক অনেক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। ফলে তিনি অনন্য এক নেতায় পরিণত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া যেমন বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনই আমরা এখন মনে করতে পারি শেখ হাসিনা ছাড়াও বাংলাদেশের সঠিক উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্ত্মবায়ন আর কারও পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই তাকে রক্ষা করার সর্বাত্মক প্রয়াস মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাঙালি জাতির মাঝে থাকতে হবে, থাকতে হবে তার প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য ও মমত্ববোধ। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ উপলক্ষে দেশে আনন্দ উৎসব চলছে। এটি সত্যিকার অর্থে আনন্দের খবর। অভিনন্দন সরকার ও জনগণকে। সর্বোপরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এটি ধরে রাখতে উন্নয়ন কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে, স্বনির্ভরতা বাড়াতে হবে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহমদ: কলাম লেখক ও গবেষক